অভাবে জীবন নষ্ট

প্রশ্নগুলো কোন রাজনৈতিক দলের কাছে না, কোন সরকার কিংবা ব্যাক্তির কাছেও না। বিগত ২০টা বছরের কাছে প্রশ্নগুলো করছি।
মানুষের বেঁচে থাকতে গেলে মৌলিক একটা জিনিস লাগবেই । গায়ের কাপড়, থাকার ঘর, চিকিৎসা কিংবা শিক্ষা – এগুলো থাকুক বা না থাকুক, খাবার অবশ্যই লাগবে । একটা জিনিস খেয়াল করেন, দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলোর উদ্দেশ্য বা পরিণাম কোথায় যেয়ে দাঁড়াচ্ছে ? শুরুতেই খাবার এবং এরপর আস্তে আস্তে অন্যান্য মৌলিক চাহিদায় যেয়ে ঠেকছে নিশ্চয়ই ? তাই নয় কি ?একজন দিনমজুর ভোরে বের হয় মাটিকাঁটার কাজ পাওয়ার আশায়, তাহলে সেইদিন তার খাবার খরচ হবে । আর আমি-আপনি পরীক্ষায় ভালো করার চেষ্টা করি, ভালোভাবে ব্যবসা করি- ভালো ক্যারিয়ারের জন্য।ক্যারিয়ার ভালো হওয়া মানে ভালো ভাবে খেতে পারা , ভালোভাবে থাকতে পারা। বিশ্বাস করেন, আমার বেলায় আমি বলি- যদি পরীক্ষায় ভালো করার সাথে ভালো ক্যারিয়ারের হাতছানি আর ভালো থাকার উদ্দেশ্য না থাকতো, আমি পড়ালেখা করতাম না। একজন দিনমজুর-ও ঘর থেকে বের হত না, যদি তার খাবারের নিশ্চয়তাটুকু থাকতো।

কিছু খণ্ড চিত্র তুলে ধরছি । ফসলের দাম পাইনা কিন্তু কিনতে গেলে জিনিসের দাম কমেনা, মানুষের আয় বাড়েনা তাই কাজের জন্য লোকও লাগেনা, সুদে টাকা নিসিলাম এখন লোকজন এসে গাভীর বান কেটে দিসে টাকা না দিলে এনজিও চলবে কিভাবে সেই কথা জিজ্ঞেস করে – এরকম ভুক্তভোগী মানুষগুলো গাঁও- গেরাম থেকে শহরমুখী হয় শুধুমাত্র কারণ একটাই- কাজ না করলে খাবে কি , এই প্রশ্নের উত্তর জেনে নিয়ে কাজ খোঁজার জন্য ।

কৃষক পায়না ফসলের দাম, অথচ রাইস মিল মালিকের এক একজনের ঠাটবাঁট দেইখেন। কিভাবে সম্ভব ? সুদের টাকা না দিলে এনজিও চলবে না ? হাস্যকর কথা। এনজিওগুলোর প্রাপ্ত অনুদানের হিসাবে গেলাম না তাই। ভাই , এই চক্করে পরতেসে গ্রামগঞ্জের মানুষগুলো। বাধ্য হয়ে বছরের পর বছর তারা ঢাকা শহরে ঢুকেছে। এরপর ঢাকায় এসে কি করছে ? যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ খুঁজে নিচ্ছে এবং শহর–সভ্যতাকে তার পেশাগত কাজ দিয়ে গতিশীল করছে । এবং এটাই বাস্তবতা । আমি-আপনি, আমরা ভাইরাসের শঙ্কায় অন্তত ১ দিনের খাবার হলেও বেশী কিনে রাখতে পেরেছিলাম লকডাউনের। হুম, কম খেয়েছি বা ৩ জনের খাবার ৫ জন ভাগ করে খেয়েছি। কষ্ট আমাদেরও হয়েছে । কিন্তু আমি বুঝাতে চাচ্ছি একটা শ্রেণির হাত কিন্তু একদম খালি ছিল। আমাদের মত ভাগ করেও কিন্তু এরা খেতে পারেনি তখন । একদম শূন্য পেট বোঝেন ? রোজার সময় সেহ্রির ১০-১২ ঘণ্টা পর ইফতারের আগে যখন প্রচণ্ড খিদায় পেট কামড়ে ধরে , ইফতারের আগে আগে নিজের মুখ থেকে কেমন যেন একটা জৈবিক গন্ধ আসে ? সেটা হল শূন্য পেট । দিনমজুরেরা সেইভাবে কাটায় সারাদিন।এদের না খাওয়া মানে না খাওয়া । দিনের টাকা দিনে উপার্জন করতে পারলে সেইদিন তাঁদের খাবার জোটে । আর সমাজের অবস্থাসম্পন্নদের বেলায় না খাওয়া মানে পেট না ভরে , নিজেদের পছন্দমত না খাওয়া। কিন্তু যা আছে সেটা ভাগ করে খাওয়া। পার্থক্যটা এখানে।

আচ্ছা, কল্পনা করুন তো, একটা ট্রাক ব্রেক ফেইল করেছে রাস্তায়। সেটা আমার বা আপনার দিকে ছুটে আসতেসে। যদি আমার বা আপনার আত্মহত্যার পরিকল্পনা না থাকে তো আমি নিশ্চিত আমরা যেভাবেই হউক , বাঁচার চেষ্টা করবো। এই কাজটা কি এতক্ষণ যাদের কথা বললাম তাঁদের বেলায় ব্যাতিক্রম ? সেও আমার আপনার মতই জীবন বাঁচাতে চাইবে। জীবনের মায়া, বেঁচে থাকার ইচ্ছা সবারই সমান। কিন্তু পার্থক্য কোথায় জানেন ? ঐ যে উপরে লিখেছি । খাওয়া আর না খাওয়া টা এখানে factor। lock down এর সময়কার কথা বলছি। এটা খেটে খাওয়া মানুষদের পক্ষে এইটা কতটুকু মেনে চলা সম্ভব ছিল ? তাঁদের কাছে “ভাইরাস এটাক করলে যদি  যদি বেঁচে না থাকি”- এই ভয়টার চাইতেও বড় ভয় যদি আজকে না খেয়ে থাকতে হয় !

আমি নিজে জরুরী সেবা দিয়েছিলাম । তাই লকডাউনের সময় রাস্তায় ছিলাম। নিজে দেখেছি ভাই- একটা গাড়ি এসেছে, রাস্তায় ব্যাক্তিগত কাজের জন্য সাময়িক দাঁড়িয়েছে। একজন বৃদ্ধলোক লাঠিতে ভর করে গাড়ির কাছে যেয়ে তার পরনে পাঞ্জাবিটা দিয়ে গাড়ির windshield মুছে দিয়ে গাড়ির মালিকের কাছে কিছু পারিশ্রমিক চাইছে । এই মানুষটাকে কিভাবে আমরা লকডাউন কি তা বোঝাবো ? আমি লকডাউনের বিরোধিতা করিনি  তখন এবং এখনো করছিনা  । বিগত দিনগুলোতে যা হয়েছে সেগুলো শুধু শেয়ার করলাম এত দিন পর । শেয়ার করার কারণ হল লকডাউনের সময় আমার এক পরিচিত -এলাকার দিনমজুর বের হয়েছিল রাস্তায় কাজের সন্ধানে।  লাঠির বাড়িতে লোকটার হাত ভেঙ্গে গিয়েছিল। আজকে উনার সাথে দেখা হওয়ার পর মনের কথাগুলো জানলাম। ভাঙা হাত দিয়ে এখন কিছুই করতে পারেনা তেমন। সংসারে উপার্জনক্ষম বলতে শুধু উনিই আছেন। হাত ভাঙ্গার পর থেকে যে অভাব আর কর্মহীন সময় কাটছে , সেটা এখন এসে প্রকট আকার ধারন করেছে। 

আমার দেশে তো অনেক কিছু হচ্ছে। কানে আসে, চোখে পরে – তাই একটু আকটু জানার সৌভাগ্য হয়। কি নাকি gdp বাড়ছে, রেল-সেতু কি কি নাকি হচ্ছে । আবার বছর দশেক আগে এয়ারপোর্টের নাম পরিবর্তন করার মত অ-নে-ক গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজও হয়েছিল  !!!! কিন্তু একটু খেয়াল করি বিষয়গুলো- পরিবর্তিত নামের এয়ারপোর্টের কাছের রাস্তাতেই ভবঘুরে কিংবা দিনমজুরেরা খালি পেটে রাত কাঁটায় । ঠিক এভাবেই যদি কোটি টাকার রেল project শেষে সেই টার্মিনালেও অনাহারী মানুষ রাত কাটায় , তাহলে প্রতি দশক পর পর এমন পরিস্থিতি দেখা ছাড়া তো কোন উপায় থাকবেনা।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *